রাধা অষ্টমী
রাধা হিন্দুশাস্ত্রমতে কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতাররূপে দ্বাপরযুগে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন; আর বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী জন্মগ্রহণ করেন বৃষভানুর কন্যারূপে রাধা নামে (রাধার জন্ম সম্পর্কে অবশ্য ভিন্ন মতও আছে)। বয়ঃক্রমকালে আয়ান ঘোষের সঙ্গে রাধার বিয়ে হয়, কিন্তু তাঁর জীবন কাটে কৃষ্ণপ্রেমে, আর কৃষ্ণবিরহে। রাধাকৃষ্ণের এই প্রণয়-কাহিনীর অন্তরে নিহিত রয়েছে এক উচ্চ মার্গীয় দার্শনিক তত্ত্ব। কৃষ্ণ মূলত স্বয়ং বিষ্ণু বা ঈশ্বর, আর রাধা তাঁর জীবনসঙ্গিনী লক্ষ্মী। মর্ত্যে তাঁরা ভিন্ন পরিচয়ে জন্মগ্রহণ করলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। ভারতীয় দর্শনমতে বিষ্ণু হচ্ছেন পরমাত্মা, আর সব জীবাত্মা। জীবাত্মার সর্বদা আকাঙ্ক্ষা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়া। পরমাত্মা বিষ্ণুই হচ্ছেন একমাত্র পুরুষ, আর সব প্রকৃতি অর্থাৎ নারী। রাধা এখানে সকল জীবাত্মার প্রতীক এবং কৃষ্ণ বিষ্ণু বা পরমাত্মার প্রতীক। তাই কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রণয়াসক্তি পরমাত্মা-জীবাত্মার শাশ্বত মিলনাসক্তিরই নামান্তর, অর্থাৎ পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার আত্মসমর্পণ। এটাই রাধাকৃষ্ণ তত্ত্বের মূল কথা এবং ভারতীয় দর্শনেরও সার কথা।
রাধা জন্মসূত্রে একজন সাধারণ গোপনারী হলেও কৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গে তিনি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছেন। কৃষ্ণপ্রিয়ারূপে রাধার (রাহিআ/রাধিকা) প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হালের প্রাকৃত কাব্য গাথাসত্তসঈ-তে। পরে বিভিন্ন পুরাণ (যেমনঃ পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ইত্যাদি), সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশএর উপখ্যান এবং নারদপানচরিতা কাব্যে রাধার উল্লেখ আছে। বারো শতকে জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দম্ এবং চৌদ্দ শতকে বড়ু চন্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ রাধাকৃষ্ণের এই প্রণয়লীলা চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা পদাবলি সাহিত্যের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের ভক্তিতত্ত্বমূলক পদসমূহ। বর্তমানেও পদাবলি কীর্তন নামে রাধা-কৃষ্ণের তত্ত্বমূলক পালাগান বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গীত হয়। আধুনিক গানের পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কীর্তন গান শহুরে শ্রোতাদেরও হূদয় আকর্ষণ করে। এ গান ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই প্রিয়। রাধাকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র। কৃষ্ণের সাহচর্যগুণে রাধা গোপী থেকে দেবীর পর্যায়ে উন্নীত। কৃষ্ণের পাশাপাশি তিনিও এখন সমান গুরুত্বের সঙ্গে ভক্তদের পূজা পেয়ে থাকেন। রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি হিন্দুদের, বিশেষত বৈষ্ণবদের পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির বিষয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনে রাধাতত্ত্ব পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, অর্থাৎ বৈষ্ণবধর্মের মূল কথাই রাধাকৃষ্ণের প্রেমতত্ত্ব; রাধাকৃষ্ণের যুগল রূপের অন্তরালে তাঁরা এক ঈশ্বরকেই কল্পনা করেন।
বৈশ্য কুলোদ্ভব বৃষ ভানু গোকুলের রাজা ছিলেন। পরম ধার্মিক রাজা ও তাঁর পত্নী ভগবদ নিষ্ঠ কীর্তিদা সন্তান লাভের জন্য বহু তপস্যা করেন। কিন্তু তাঁদের আশা পূর্ণ হল না। শেষে বৃন্দাবনের যমুনা তীরস্থ ৫১ সতী পীঠের অন্যতম কাত্যায়নী পীঠে বৃষ ভানু জগন্মাতার কঠোর তপস্যায় ব্রতী হন। ১০০ বছর পর দেবী আকাশবাণীর মাধ্যমে রাজাকে ভুবন মঙ্গল হরিনাম গ্রহন করে তারপর দেবী উপাসনা করতে আদেশ দেন। রাজা সে আদেশ মেনে “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”— এই মহামন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে আদ্যাশক্তির উপাসনায় ব্রতী হলেন। অল্পদিন পর মহাদেবী আবির্ভূত হয়ে রাজাকে এক সহস্র সূর্য তুল্য ডিম দান করলেন। রাজা এটি রানীর হাতে তুলে দেবামাত্রই সেই দিব্য ডিম হতে কোটি সূর্যের প্রভাযুক্ত,অর্ধচন্দ্র শোভিত,বিশাল নয়না, দিব্যগন্ধ-মাল্য-অলঙ্কার ভূষিত , অষ্টভুজা রাধারানীর আবির্ভাব ঘটল। বাৎসল্য ভাবের পুষ্টির জন্য এরপর তিনি দ্বিভুজ কন্যায় পরিণত হলেন। সেই দিন টি ছিল ভাদ্র শুক্লা অষ্টমী তিথি যা ত্রিলোকে রাধাষ্টমী নামে খ্যাত হল। রাজদম্পতি ভগবতী রাধারানীর কৃপায় জানলেন যে বিশ্বেশ্বরী জগন্মাতাই তাঁর গৃহে কন্যা রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
এই পুন্য তিথিতে রাজা বৃষ ভানু কৃত রাধা স্তুতি উদ্ধৃত করে বলি,” হে বিশ্বেশ্বরী, বিশ্বেশ্বর পূজিত তোমার যে পাদপদ্ম আমি সেই চরণে প্রনত হই। ব্রমহা,হরি,শিব,ইন্দ্র—এই সব মূর্তি তোমারি। তুমি ভিন্ন জগতে আর অন্য বস্তু নেই। জগত ভ্রান্তি মাত্র। হে মাতঃ, কৃপা করে আমাকে নিজ দাস জেনে অনুগ্রহ করো।”
অন্য কাহিনিঃ-
কৃষ্ণ ভাবছেন আমি আমার লীলা বিস্তার করবো। তার বাম পাশ থেকে রাধারানী বিস্তার হয়ে গেলেন। রাধারানী তার বিভিন্ন সেবা আয়োজন করে ভগবানকে সন্তুষ্ট করেন। রাধারানী সেবা বিস্তার করার জন্য তার বাম পাশ থেকে অনেক গোপী বিস্তার করেন। গোপীগন রাধারাণীর মতো দেখতে। এভাবে কৃষ্ণ যখন মনস্থির করলেন যে আমি দ্বাপর যুগে ব্রজধামে অবতীর্ণ হয়ে লীলা বিস্তার করবো। তিনি রাধারানীকে বললেন, “তুমিও আস।” তখন রাধারানী বললেন, “আমি কী করে ধরাধামে আসবো। তোমায় ছাড়া অন্য পুরুষ দেখতে পারবো না।” কৃষ্ণ বললেন, “ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। বৃষভানু মহারাজের পত্নী কীর্তিদা গর্ভবতী হলেন। অষ্টমী তিথির মধ্যাহ্নে রাধারানীর জন্ম হলো। এই তিথীতে বর্ষানার ভক্তবৃন্দ গোপ- গোপীগণ সেখানে তারা আনন্দে নাচছে যে, বৃষভানু মহারাজের কন্যা হলেন। কিন্তু রাধারানীর পিতা – মাতার একটা হচ্ছে দুঃখ হচ্ছে যে, রাধারাণী চোখ খুলছে না। ভাবছে আমাদের কন্যা অন্ধ। চোখ খোলে না। নারদ মুনি নন্দ মহারাজের কাছে গেলেন। তার সন্তান দেখার জন্য। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে হাতে নিয়ে আশির্বাদ করেছেন। তোমার খুব ভাগ্য। এ সন্তান নারায়ণের মতো হবে। তুমি এ সন্তানকে যত্ন করো পূজা করো, সন্তানকে যত্ন করো। তোমার আর কোন পূজা করা লাগবে না। এভাবে বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে নন্দপুত্রকে আর্শিবাদ দিলেন। নারদ মুনি বুঝলেন, কৃষ্ণ আবির্ভাবের পক্ষকাল পর কে আসে? কে আসে? রাধারাণী। নারদমুনি ব্রজের আশপাশে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে খোজ করছেন, তোমার কোন কন্যা সন্তান হয়েছে? সব সন্তান নিয়ে এস আমি আশির্বাদ করবো। সন্তান নিয়ে আসলে আশির্বাদ করলো। পরপর বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে খোঁজা হলো। কিন্তু যাকে খুঁজছেন তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন কীর্তিদা বৃষভানু মহারাজের বাড়িতে গিয়েছেন। সেখানে শ্রীদামসহ বিভিন্ন সন্তান নিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি জীজ্ঞাসা করলেন, “আরো একটা মেয়ে সন্তান হয় নি। আমি একটু দেখি দেখাও।” তখন দেখছে সুন্দর রাধারানী নিয়ে এসছে। পনের দিন বয়স। তাঁর মুখমণ্ডল কোটিচন্দ্রের ন্যায় জ্যোতির্ময়। তাকে নারদ মুনির হাতে দিয়েছে। নারদ মুনি রাধারানী, হ্লাদিনী শক্তি, আনন্দের শক্তি হাতে পেয়ে এমন আনন্দে বিভোর হয়েছেন যে, কোনো কথা বলতে পারছেন না, নড়তে পারছেন না। আর শুধু গায়ে কাঁপছে আর চোখের জল গঙ্গা হয়ে পড়ে যাচ্ছে। বৃষভানু মহারাজ ভাবছেন কী করবে। নারদ মুনি একটু স্থির হয়েছেন। তিনি বললেন, “তুমি দুঃখ করো না।” আর ঠিক যেমন কৃষ্ণের পিতা মাতার মতো বলেছেন, “তুমি এ মেয়েকে যত্ন করো, পূজা করো। তোমার আর কোনো পূজা করা লাগবে না।” এভাবে নারদ মুনির ইচ্ছে ছিল রাধারানীর কিশোরী রুপ দর্শন করবেন। তাই তিনি ব্রজবনে গিয়ে ধ্যান করে প্রার্থনা শুরু করলেন রাধারাণী দেখা দাও, দেখা দাও। তখন রাধারাণী গোপীগণের সাথে কিশোরীরুপে দেখা দিয়েছেন। তখন গোপীগণ নারদমুনিকে বলেছেন, তুমি যে রাধারাণীর দর্শন পাচ্ছ তার অর্থ রাধারাণীর অসীম কৃপা হয়েছে। রাধারাণীর দর্শন পাওয়ার জন্য কতো যোগী কয়েক কল্পে তপস্যা করেছেন। একটা কল্পে হাজার যুগ, ষোল মন্বন্তর। নারদ মুনি বললেন, “ভবিষ্যতে তোমার মেয়ের দৃষ্টি আসবে। চোখ খুলবে।” একদিন বড় একটা উৎসব হলো। শিশু কৃষ্ণ এসে হামাগুড়ি দিয়ে শিশু রাধারানীর কাছে গিয়েছে। আর রাধারাণী চোখ খুলে শিশু রূপে কৃষ্ণকে দেখেছেন। তিনি অন্তরঙ্গা শক্তি। তটস্থা শক্তি আর বহিরঙ্গা শক্তি। অন্তরঙ্গা শক্তি হচ্ছে রাধারানী। আর বহিরঙ্গা শক্তি পার্বতী বা দুর্গা। আমরা জীবশক্তি আমরা মাঝখানে পরি। যখন আমরা কৃষ্ণের সেবা করবো, তখন আমরা অন্তরঙ্গা শক্তি রাধারাণীর আশ্রয়ে থাকবো। যদি আমরা মায়াকে না বলি অর্থ মায়া যদি আমাদের বলেন ভোগ করো আর আমরা যদি তাকে বলি ‘না’, আমরা কৃষ্ণের সেবা করবো, তাহলে আমরা অন্তরঙ্গা শক্তির অধীনে মধ্যে পড়ি। মায়া আমাদের যখন ভোগ বিলাস করার আয়োজন করে আর আমরা যদি বলি ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ আমরা ভোগ করতে চাই, তখন আমরা মহামায়ার অধীনে থাকি এবং আমাদের কর্মফল অনুযায়ী আমাদের মায়ার অধীনের মধ্যে সুখ দুখ পেতে হবে। ভগবদগীতায় আছে মনুষ্যানাং সহস্রেষু কশ্চিৎ যততিসিদ্ধয়ে। অর্থাৎ কৃষ্ণের সমন্ধে খুব অল্প জানে পারে। কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেবের কৃপাতে আমরা রাধা কৃষ্ণ সমন্ধে অনেক কিছু জানতে পারি। কিন্তু আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। যদি আমরা মনে করি রাধাকৃষ্ণের লীলা জড়জগতের স্ত্রী পুরুষের মতো হয় তবে মহা অপরাধ। আমাদের জানতে হবে রাধারাণী হচ্ছেন কৃষ্ণ প্রেমস্বরূপিনী। তিনি কৃষ্ণের প্রেমসেবা করেন। সেটা সম্পূর্ণ
ভাবে পারমার্থিক তত্ত¡। এইভাবে যদি আমরা রাধাকৃষ্ণকে সেবা করি তবে আমরা সেই পরম তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারবো। আসা করি এই রাধাষ্টমীতে রাধারাণীর যে প্রেমভক্তি তার একটা বিন্দু কমপক্ষে আস্বাদন করতে পারেন। এর থেকে আর বড় কোনো প্রার্থনা নাই।
সনাতন ধর্মালম্বিরা রাধা অষ্টমীতে উপবাস থেকে পূজার্চনা করে। বিভিন্ন স্থানে শ্রীমদ্ভভাগবত পাঠ ও উদয়াস্থ ব্যাপী চলে হরিনাম সংকীর্তন আর মহা প্রসাদ বিতরণ। মঙ্গল আরতী, রাধা রানীর স্নানে শতশত রাধাভক্ত হিন্দু নারীরা কলসী নিয়ে নৃৃত্য-গীত গেয়ে বর্নাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়জন করে। সারাদিন উপবাস থেকে এ উৎসবে সনাতন ধর্মালম্বি ভক্তবৃন্দ অংশ গ্রহন করেন।